ক্লেপটোম্যানিয়াক
-সুস্মিতা
বেঙ্গালুরু শহরের ইন্দিরানগরে মঞ্জরিদের থ্রি-বি-এইচ কে অ্যাপার্টমেন্টের ড্রয়িংরুমটা আজ ফুল আর ধূপের গন্ধে ভরে গিয়েছে। ঘরের ভিতরে তিল ধারণের জায়গা নেই…অথচ সেখানে একটা সূঁচ পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে, এমন নিথর নৈঃশব্দ…।
ঘরের ঠিক মাঝখানে শোয়ানো রয়েছে রিকিকে। সাদা ফুলের মধ্যে থেকে শুধু দেখা যাচ্ছে দশ বছরের ছোট্ট মেয়ে রিকির নিষ্পাপ শিশু মুখটুকুনি। রিকির মাথার কাছে বসে আছে ওর মা মঞ্জরি…ওর পরণে এখনও গতকালের রাত্রিবাস। মঞ্জরিকে আগলে ঘিরে রয়েছে ওর চারপাঁচজন বান্ধবী। ওরা কেন মঞ্জরিকে আগলে রেখেছে? মঞ্জরি তো কাঁদছে না…ও শোকে ভেঙ্গেও পরেনি। ও যেন কিছু বুঝতেই পারছে না…ওর কোনো বোধই নেই …
মঞ্জরি শুধু ভাবছে…রিকু সোনাটা আজ বড় বেশি সময় ধরে ঘুমোচ্ছে…। অন্যান্য দিনে তো রিকি এই সময়ে ঘরের মধ্যে খেলা করে নয়তো স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে স্কুলবাস ধরতে যায়। আজ রিকি এতো ঘুমোচ্ছে কেন? ও কি আর জাগবে না?কোনোদিন ঘুম থেকে উঠবে না? খেলবে না? স্কুলে যাবে না? সবাই এসব কি বলছে?
মঞ্জরির জীবনটা যে শুধুই পুতুলের মতো ওই বাচ্চা মেয়েটাকে নাওয়ানো খাওয়ানো, পড়ানো আর তাকে স্কুলে, আঁকার ক্লাসে, সুইমিং ক্লাসে পাঠানো নিয়েই কাটে। রিকি ঘুমিয়ে পড়লে মঞ্জরি থাকবে কি নিয়ে? ওর জীবনটা কাটবে কি করে? মঞ্জরি সত্যিই কিছু ভাবতে পারছে না, বুঝতে পারছে না। ওর চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে আসছে কিছু দৃশ্য …
বারো বছর আগের কথা। শ্যামবাজারের ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ এর বনেদি বাড়ির মেয়ে মঞ্জরির বিয়ে হলো প্রবাসী বাঙ্গলী পাত্র প্রসূন রায় চৌধুরীর সঙ্গে। বংশ কৌলিন্যে, চেহারায় এবং বিদেশে চাকরীর সুবাদে প্রসূন বড়ই দামী এবং লোভনীয় পাত্র। মা-বাবার সাথে সাথে মঞ্জরিও দারুণ খুশি। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী ও বান্ধবীদের দিকে বিজয়িনীর হাসি হেসে বিয়ের পরের সপ্তাহেই মঞ্জরি চললো ইওরোপে…তার নূতন সংসার পাততে। দু’ চোখের পাতায় তখন সুখের স্বপ্ন আঁকা …
ইওরোপের যে শহরে মঞ্জরি প্রসূনের নূতন জীবন শুরু হলো তার আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষই স্প্যানিশ ভাষাভাষী। উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করা মঞ্জরির এটাই ছিলো প্রথম ধাক্কা। ইংরেজীতেও যে ও খুব সাবলীল,তা নয় …তবুও স্প্যানিশ এর তুলনায় ভাষাটা কিছুটা পরিচিত তো বটে।
প্রসূন নিজেও যেন হাবেভাবে বড্ড বেশি বিদেশী।
ইওরোপের অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য, ছবির মতো সাজানো বাড়িঘর…সবকিছুর মাঝেও নবদম্পতির প্রেমের মধ্যে কি যেন একটা ফাঁকি…। নূতন জীবন, নূতন পরিবেশ, নূতন সম্পর্ককে বুঝতে বুঝতেই সময় হু হু করে কেটে গেলো। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় মঞ্জরি প্রসূনের জীবনে এলো রিকি।
মাতৃত্ব যে একটা মেয়েকে কি দিতে পারে…।
রিকিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে মঞ্জরি প্রথম বুঝতে পারলো- ‘ডলার কিম্বা পাউন্ড নয়,ইওরোপ আমেরিকা,বংশকৌলিন্য,রূপ বা পদমর্যাদাও নয়…স্বর্গীয় সুখের স্বাদ এনে দিতে পারে ফুলের মতো নিষ্পাপ একটি শিশু। আত্মজাকে পেয়ে জীবনের সব ছোটখাটো শুন্যতা ভুলে গেলো মঞ্জরি। দিন ওর কাটে শুধুই রিকির যত্ন করে, রিকি সোনাকে আদর করে আর ওর সাথে খেলা করে। প্রসূন চাকরী জীবনে তখন দিনেদিনে আরও বেশি ব্যস্ত। ও ভোরবেলা অফিসে বেরিয়ে যায়…বাড়ি ফিরতে ফিরতে গভীর সন্ধ্যা। সময় সুযোগ পেলে মেয়েকে আদর অবশ্যই করে, কোলে নিয়ে অনেক কথাও যে বলে না তা নয় …তবে সে সব কথাই ইংরেজি ভাষায় ।
প্রথম অসুবিধাটা টের পাওয়া গেলো রিকির আঠারো মাস বয়সে। সে দেশের প্রথা অনুযায়ী রিকি যেতে শুরু করলো প্লে–স্কুলে। সেই স্কুলের শিক্ষিকা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলেন। স্কুলের বাকি বাচ্চারা হয় ফ্রেঞ্চ, নয় স্প্যানিশ অথবা জার্মান। বাড়িতে রিকির মায়ের যত কথা বাংলায়। বাবা সময় পেলে কথা বলেন ইংরেজিতে। রিকির মস্তিষ্ক কোনো ভাষাই সঠিকভাবে অনুকরণ করতে পারে না। জিভের জড়তা ভাঙ্গে না। রিকি কিছুতেই কথা বলতে চায় না। ও কারুর সাথে মিশতেই চায় না।
মঞ্জরি নিজেও ভাষা নিয়ে বড় হীনমন্যতায় ভোগে। প্রসূনের সময় নেই এসব ঝামেলা নিয়ে মাথা ঘামানোর। তবুও অসহায় মঞ্জরি জোর করে সমস্যার কথা বলতে গেলে ওর সোজাসাপটা সমাধান- “তুমি নিজে ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাস জয়েন করো আর মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। এসব সামান্য বিষয় নিয়ে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই …ব্যস”।
মঞ্জরির নিজের আর লজ্জা ভেঙ্গে কোনো ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাসে ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠে না।রিকিকে নিয়েও কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় না…সেখানে কোন্ ভাষায় ও নিজেদের সমস্যার কথা জানাবে?
দেখতে দেখতে রিকির প্রায় সাড়ে তিন বছর বয়স হলো।ও বড় একা, মুখচোরা বাচ্চা।ওর সমবয়সী কোনো বন্ধু নেই…। রিকির মা ই ওর একমাত্র বন্ধু। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে মঞ্জরি মেয়ের সাথে যত মনের কথা বলে। রিকি বড় বড় চোখ মেলে সেসব কথা শোনে। ও কিন্তু বোবা নয়…কিন্তু ওর জিভের জড়তা কাটছে না। ইংরেজি,স্প্যানিশ আর বাংলা মিশিয়ে ও টুকরো টুকরো কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু সেসব প্রায় কেউই বোঝেনা। রিকি দিনে দিনে আরও গুটিয়ে যেতে থাকে।
ইতিমধ্যে রিকির বাবার আরও উন্নতি হয়েছে। এবার ওরা পাড়ি দিলো জার্মানি। জীবন সেখানে আরও কঠিন। রিকির বাবা নূতন দেশে নূতন চাকরীতে আরও বেশি ব্যস্ত।আবার একটা একেবারে নূতন ভাষা ছোট্ট রিকির জীবনকে আরও কঠিন করে দিলো।ওর মাও যে এই সমস্যায় রিকিকে কোনো সাহায্য করতে পারে না।
নূতন দেশে নূতন স্কুলে ভর্তি হয়ে রিকি নিজেকে আরও বেশি গুটিয়ে নিলো। ও যেন মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে “সমবয়সীদের সাথে ও কথা বলবে না…খেলবে না”।
জার্মানিতে কাটলো মোটে দেড় বছর। প্রসূনের উন্নতি তখন গগনচুম্বী। ওদের এরপরের ঠিকানা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট। ইওরোপ থেকে আমেরিকা…এ যেন মঞ্জরি আর রিকির কাছে পৃথিবীর উল্টো পিঠ। আবার…আবার একটা নূতন দেশ, নূতন সংস্কৃতি আর আমেরিকান স্কুলের ইংরেজির সাথে রিকির আর বন্ধুত্ব হলো না।হয়তো হয়ে যেত…কিন্তু ততটা সময় পাওয়া গেলো না।
রিকির সাত বছরের জন্মদিনে মঞ্জরি উপহার পেলো- “প্রসূনের দেশে বদলী হওয়ার চিঠি”। যদিও পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতা নয় তবুও নিজের দেশ তো …। মঞ্জরির খুশি আর ধরেনা। ও যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলো। ছোট্ট রিকি কিন্তু মায়ের এতো খুশির কারণ সঠিক কিছুই বুঝলোনা। ওর সাত বছরের জীবনে ও তিনবার দেশে এসেছে ঠিকই কিন্তু দাদু দিদার আদর ছাড়া ওর আর সেরকম কিছু মনে পরছেনা।
অবশেষে প্রায় আটবছর বিদেশের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ২০১০সালের মার্চ মাসে বেঙ্গালুরু শহরে ফিরে এলো মঞ্জরি,প্রসূন আর রিকি। তিনজনের মধ্যে মঞ্জরিই সব থেকে বেশি খুশি। মঞ্জরির মনে হলো-এবার ওদের জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বন্ধু বান্ধব আর আনন্দে ভরে উঠবে ওর আর রিকির জীবন। অনেক সমবয়সী বাঙ্গালী বন্ধু বান্ধবী পেয়ে মঞ্জরির জীবনে খানিকটা হলোও তাই। প্রসূন কাজ পাগল মানুষ…যেখানেই থাকুক,কাজে ব্যস্ত থাকলেই ও খুশি।
কিন্তু রিকির কি হলো ?
বয়সের হিসেব অনুযায়ী সি.বি.এস.ই. বোর্ড এর স্কুলে ক্লাস টু’তে ভর্তি হলো রিকি।দক্ষিণ ভারতের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। সেখানে পড়াশোনার মান বেশ উঁচু আর তার সাথে পড়তে হবে দ্বিতীয় ভাষা কন্নড়। রিকির ছোট্ট জীবনটা যেন আরও গুলিয়ে গেলো। দক্ষিণ ভারতীয় শিক্ষিকাদের উচ্চারণ ছোট্ট মেয়েটা কিছু বোঝেনা আর রিকির কথা তো কেউ বুঝতেই পারে না। ইওরোপ আমেরিকায় রিকির স্কুলে এতদিন পর্যন্ত পড়াশোনার পদ্ধতিও ছিলো একেবারে আলাদা।
এখানে রিকির সাথে কেউ কথা বলেনা, ওকে কেউ খেলতে ডাকে না…বরং ওর উচ্চারণ নিয়ে বন্ধুরা হাসাহাসি করে। শিশুরাও যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে।
রিকির মা আজকাল অনেক বান্ধবী, অনেক আড্ডা, অনুষ্ঠান পেয়ে আগের থেকে অনেকটা বেশি খুশিতে থাকেন। রিকির মাঝেমাঝে মনে হয় “মা যেন অনেক দূরের মানুষ হয়ে যাচ্ছে”। কিন্তু রিকিও তো বড় হচ্ছে…ওরও সঙ্গী দরকার…আনন্দ দরকার। রিকি সেই আনন্দ সেই আশ্রয় খুঁজে নেয় টেলিভিশনের বড়দের অনুষ্টানের মধ্যে…
আজকাল রিকির খুব নিষ্ঠুর হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে-যারা ওর উচ্চারণ নিয়ে হাসাহাসি করে তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে। নিজের মতো একটা রাস্তা খুঁজে বের করে রিকি…স্কুলের লাঞ্চব্রেকের সময় ওকে কেউ খেলতে ডাকেনা, একেবারে একা একবুক কান্না বুকে চেপে রিকি ক্লাসরুমে বসে থাকে …।বাইরে খেলার মাঠে বাকি বাচ্চারা তখন টিফিন ভাগ করে খাচ্ছে , খেলছে। ঠিক সেই সময় সহপাঠীদের ব্যাগ থেকে তাদের পছন্দের ইরেজার, পেন্সিল নিঃশব্দে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয় রিকি। কি যে এক নিষ্ঠুর উল্লাস মনের মধ্যে টের পায় তখন সে। ভীষণ উত্তেজনা…দারুণ আনন্দ হয় …।
ঘটনাটা মঞ্জরি প্রথম জানতে পারলো যেদিন রিকির ক্লাসটীচার মঞ্জরিকে স্কুলে ডেকে পাঠালেন। অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় শিক্ষিকা রিকির আচরণের এই দিকটি খুলে বলেন। তিনি বিশেষ ধৈর্যসহকারে বেশ কয়েকদিন ঘটনাটি আড়াল থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন …এবং শেষপর্যন্ত একদিন একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলার পরেই মঞ্জরিকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
লজ্জায় দুঃখে অপমানে মঞ্জরির একেবারে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ও একেবারে হতবাক্ …কোনো কথাই বলতে পারলো না…না খুঁজে পেলো এর কোনো কারণ ,কোনো ব্যাখ্যা…। পাশেই রিকি দাঁড়িয়ে…মাথা গোঁজ করে মাটির দিকে তাকিয়ে…মুখে কোনো কথা নেই ।
বাড়িতে ফিরে এসে মঞ্জরি মেয়েকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরে, একবার শক্ত হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে জানতে চাইলো- “বল বল কেন এমন কাজ করেছিস বল? আমাদের কাছে না চেয়ে কেন অন্যের জিনিষ নিয়েছিস? জানিস না এটাকে চুরি বলে?”- রিকির মুখে কোনো উত্তর নেই…ঘাড় শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে ও …
মঞ্জরিরা যে সোসাইটিতে থাকে, সেখানে প্রায় সব বাচ্চারাই রিকির সাথে এক স্কুলে পড়ে। দু’একদিনের মধ্যেই বিল্ডিংএর অন্যান্য ছেলেমেয়ে ও তাদের মায়েদের আলাপ আলোচনা গুঞ্জন থেকে মঞ্জরি টের পায় ‘রিকির এই চুরি করা স্বভাব এই মুহূর্তে পাড়ার মুখ্য আলোচ্য বিষয়’। লজ্জায় অপমানে কারুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনা মঞ্জরি। ভয়ে প্রসূনকেও সব কথা খুলে বলতে পারেনা। প্রসূন তো ওদের কোনো অভাব রাখেনি। বরং এতদিন বিদেশে থাকার ফলে মঞ্জরিদের জীবনে প্রাচুর্য্য যথেষ্ট বেশি।এছাড়াও পরিবার ও রিকিকে সময় দিতে পারেনা বলে প্রসূন ওর আদর্শ পিতৃত্বকে প্রমাণ করে দামী উপহার দিয়ে। তাহলে রিকির কিসের অভাববোধ?
অসহায় মঞ্জরি ফোন করে মাসতুতো দিদি চন্দ্রিমাকে। তিনি সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।সব কথা শুনে অভিজ্ঞ, সহৃদয়া চন্দ্রিমাদি ভারি সদুপদেশ দিলেন বোনকে। তিনি বললেন-“শোন,তুই কিন্তু একেবারেই উত্তেজিত হবি না,বকাঝকা বা মারধোর একদম নয় রিকিকে। অনেক কারণে যে কোনো মানুষের মধ্যেই এই প্রবণতা দেখা দিতে পারে…এটাকে ক্লেপটোম্যানিয়া বলে। রিকির দরকার সঠিক কাউন্সিলিং…গরমের ছুটিতে তোরা কলকাতায় এলে আমি নিজে ওর সাথে কথা বলবো। এতো ভেঙ্গে পড়ার মতো কিছু হয়নি। একটু ধৈর্য রাখ।”
অস্থির অশান্ত মঞ্জরির মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় সত্যজিত রায়ের কোনো একটি লেখায় প্রথম ‘ক্লেপটোম্যানিয়া’ শব্দটি পড়েছিলো ও। বালিকা বয়সে ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমা দেখে সরল মনে বাবাকে প্রশ্নও করে ফেলেছিলো মঞ্জরি- “বাবা দুর্গা কি ক্লেপটোম্যানিয়াক ছিলো ?” বাবা মাথায় হাত রেখে বুঝিয়ে বলেছিলেন- “না রে মা, অভাবের তাড়নায়, অনেক না পাওয়ার বেদনায় ছেলেমানুষ বয়সে ওরকম অনেকে
করে ফেলে।”
কিন্তু রিকির তো কোনো কিছুর অভাব নেই …ওর অভাববোধটা কোথায়? মঞ্জরির মাথা ঘুরতে থাকে …
শেষ পর্যন্ত সেই চরম অপমানের ঘটনাটা ঘটে গত পরশু সন্ধ্যায়…মঞ্জরিদের পাশের ব্লকেই মঞ্জরির বান্ধবী অদিতির ছেলে অর্কর জন্মদিন সেদিন। বাড়িতে এসে বড় সুন্দর করে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গিয়েছে অদিতি।
সকাল থেকেই ভয়ে বুক ধুকপুক্ করছিলো মঞ্জরির। আজকাল রিকি যে বন্ধুর বাড়িতেই যায়,সেখানে থেকে গোপনে নিয়ে আসে কখনও একটা রং পেন্সিল কখনো ইরেজার, দামী স্কেচ পেন বা যে কোনো কিছু। আনেক বুঝিয়েও কোনো ফল হয়নি। রিকির ব্যাগ বা ফ্রকের পকেট থেকে সেসব খুঁজে বের করে মঞ্জরি নিজে গিয়ে সেগুলো ফেরত দিয়ে আসে …সাথে বানিয়ে বলতে হয় একটা গল্প। অথচ সকলের সাথে ওর মেলামেশাটাও বন্ধ করে দিলে রিকি যদি আরও অস্বাভাবিক হয়ে যায়…
সন্ধে সাতটা নাগাদ রিকিকে সাজিয়ে গুছিয়ে , “অন্যের জিনিষে হাত দিতে নেই” বুঝিয়ে অদিতিদের ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে দিয়ে আসে মঞ্জরি।
বাড়ি ফিরে আসার পরে আধঘণ্টাও কাটেনি…
কলিংবেলের শব্দ শুনে উঠে গিয়ে দরজা খোলে মঞ্জরি…দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে থমথমে মুখে অদিতি আর ওর হাত ধরে রিকি। রিকির হাতে একটা বড় খাবারের বাক্স।
ঘরের ভিতরে ঢুকে শান্ত কণ্ঠে অদিতি বলতে শুরু করে- “দেখো মঞ্জরি,আমি তোমাকে কোনো আঘাত দিতে আসিনি, তোমার আমার বন্ধুত্ব নষ্ট হোক্ সেটা আমি একেবারেই চাইনা…সেইজন্যই বাড়ির পার্টি ছেড়ে আমি নিজে তোমার কাছে ছুটে এলাম”…মঞ্জরি ভীত অবাক চোখে চেয়ে থাকে…এরপরে আর কি শুনতে হবে তাকে?
অদিতি বলে চলে- “এতদিন পাড়ায় কানাঘুষোয় শুনছিলাম রিকির চুরি করা স্বভাবের কথা, কিন্তু আজ আমার বাড়িতে ….”মঞ্জরি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা…ওর মাথাটা তখন বন বন করে ঘুরছে…। অদিতি জানালো- “বাচ্চারা সবাই পৌঁছে যাওয়ার পরে আমরা যখন কেক কাটার আয়োজন করছি, হঠাৎই তখন আমার নজরে পড়ে রিকি সেখানে নেই। কি যেন একটা মনে হওয়াতে আমি অর্কর ঘরে যাই …সেখানে ওর জন্মদিনের পাওয়া দামী উপহারগুলো সাজানো ছিলো। গিয়ে দেখতে পাই- রিকি টেবিল থেকে আমার বাবার দেওয়া সোনার আংটি, আমার এক কলিগের দেওয়া রিস্টওয়াচটা ওর ফ্রকের পকেটে ঢোকালো ….তুমি কিছু মনে কোরোনা মঞ্জরি আমি আর রিস্ক নিতে পারলাম না। অতগুলো বাচ্চার মধ্যে কে ওকে চোখে চোখে রাখবে বলো?…তবে ও ছেলেমানুষ …ওর খাওয়া হয়নি …ওর খাবারগুলো আমি এই বাক্সতে ভরে দিয়ে গেলাম …তুমি যেন আমাকে ভুল বুঝো না “।
অপমানে ,লজ্জায়,রাগে দুঃখে মঞ্জরির আর কোনো হুঁশ থাকেনা। উন্মাদ হয়ে যায় ও…প্রথমেই রিকির হাত থেকে খাবারের বাক্সটা টেনে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ও। এই প্রথম কেঁদে ওঠে রিকি…খিদে পেয়েছে ওর …কখন থেকে কেক খাবে বলে আশা করে বসে আছে যে …। সেটা দেখে যেন মঞ্জরির মাথায় আগুন জ্বলে যায় …। জীবনে প্রথমবার মেয়ের গায়ে হাত তোলে সে…উন্মাদের মতো মেয়ের চুলের মুঠি ধরে এলোপাথাড়ি চড় মারতে থাকে মা।
চিৎকার করে কাঁদতে থাকে রিকি…কাঁদতে কাঁদতেই কত কিছু যেন বলতে চায় এতদিনের নির্বাক শিশুটি। কিন্তু আজ মঞ্জরি কোনো কিছু শোনার মতো অবস্থায় নেই। মেয়েকে ‘চোর’ ‘লোভী’ বলে গালি দিতে দিতে ধাক্কা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে দেয় মঞ্জরি। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে- “যতদিন না তোর স্বভাব শুধরাবে ততদিন বেরোবিনা তুই এই ঘর থেকে। না খেতে পেয়ে মরে যা…তবু কারুকে মুখ দেখাবি না তুই “….
মেয়েকে তার ঘরে বন্ধ করে নিজের ঘরে এসে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মা। প্রসূন অফিস থেকে যথারীতি ফেরে রাত এগারোটা নাগাদ। প্রতিদিনের মতোই তার নিয়মমাফিক ক্লান্ত প্রশ্ন- “রিকি ঘুমিয়েছে?”…মঞ্জরিরও সংক্ষিপ্ত জবাব- “হ্যাঁ,ঘুমিয়ে পড়েছে”…
বুকচাপা কষ্ট নিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদে রাত কেটে যায় মঞ্জরির…
পরদিন সকালে সাড়ে সাতটার সময় বিছানা থেকে উঠেই মেয়ের ঘরের দিকে যায় মঞ্জরি। বাইরে থেকে দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে দেখে- যেন এক পুকুর রক্তের মধ্যে কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে রিকি। বাবার শেভিং ব্লেডটা তখনও ওর ডানহাতে ধরা…বামহাতের শিরা কেটে ফেলেছে রিকি। টেলিভিশনে বড়দের সিরিয়াল দেখতে দেখতে কখন এসব শিখে ফেলেছে রিকি ?
জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো মঞ্জরি…তারপরে কি ঘটেছিলো ও জানে না …
তারপরে এখন চোখ খুলে চারপাশে এতো ভীড় …মঞ্জরি কিছু ভাবতে পারছে না, বুঝতে পারছে না …কি করে বুঝবে? গতকাল সন্ধ্যায় রিকি আনেক কিছু বলতে চেয়েছিলো …সেসব কিছু যে শোনেনি মঞ্জরি…
কোনো ডাক্তার নয়, সাইকায়াট্রিস্ট নয়…একমাত্র রিকিই সঠিক বলতে পারতো কোন্ কষ্টে কোন্ কারণে এমন ক্লেপটোম্যানিয়াক হয়ে যাচ্ছিলো ও ?
কতটা শাসন বেশি হলে,কতটা আদর কম হলে বা কোন্ অভাববোধ থেকে, কোন্ নিষ্ঠুরতা থেকে শুরু হয় মনের এমন সব জটিল অসুখ? রিকি কাল অনেক কথা বলতে চেয়েছিলো…মন্দিরা সেকথা শোনেনি। তাই আজ আর ও কিছু বুঝতে পারছেনা ।
আমরা সবাই সঠিক সময়ে কারুর কথা শুনি না …বড় দেরি করে ফেলি। মঞ্জরি এখন শুধু ভাবছে -কত তাড়াতাড়ি…কিভাবে ও মেয়ের কাছে পৌঁছাবে…তার রিকিসোনার মনের কথা শুনতে…বুঝতে …
সুস্মিতা
ভাল লাগল ।